ঢাকা || ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪

বাক, ভিন্নমত ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সংগঠনের অধিকারকে খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে: টিআইবি

বাক, ভিন্নমত ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সংগঠনের অধিকারকে খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে: টিআইবি

ব্যাংক ইনফো

প্রকাশিত: ১০:৩০, ১ জানুয়ারি ২০২৫

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর অনেক ধারা নাগরিকের বাক, ভিন্নমত ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সংগঠনের অধিকার খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে মর্মে মূল্যায়ন করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ নিয়ে টিআইবির পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এ অধ্যাদেশে অনেকাংশে পূর্বতন কালো আইনসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিমূলক বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে। টিআইবি মনে করে, তড়িঘড়ি করে সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে যথাযথ পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়ে এ অধ্যাদেশের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত।

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা বলবৎ রয়ে গেছে, যা অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রনমূলক ও নজরদারিমূলক আইনি কাঠামো সৃষ্টি করবে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অধ্যাদেশটি পর্যালোচনা করে আমরা দেখছি, এতে অনেকাংশে পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের এজেন্ডা ও ভাষ্যেরই প্রতিফলন ঘটেছে; একাধিক ধারায় পূর্বের ডিএসএ বা সিএসএ-এর পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অধ্যাদেশ জনগণের বাক, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যম এবং সংগঠনের অধিকারকে খর্ব করার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। যদিও বলা হয়েছে, নতুন অধ্যাদেশটি হবে দেশবাসীর ডিজিটাল অধিকার নিশ্চিতে সহায়ক, কিন্তু বাস্তবে এতে আমরা অনেকটাই পূর্বতন কালো আইনসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিমূলক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকতে দেখছি।

অধ্যাদেশে অনেক জটিল ও অস্পষ্ট শব্দ, শব্দগুচ্ছ ও ধারণার ব্যবহার করে এর অপব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত একাধিক ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত করে একটি জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। অধ্যাদেশটির খসড়া প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত গ্রহণ করা হয়নি এবং যথাযথ পর্যালোচনার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও দেওয়া হয় নি বরং তড়িঘড়ি করেই অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী চেতনায় গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে এমন প্রক্রিয়ায় এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিমূলক অধ্যাদেশ অনুমোদন পাওয়া বিব্রতকর।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘অধ্যাদেশ অনুযায়ী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য, যদিও ধর্মীয় অনুভূতির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। তদুপরি, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত যেমন অগ্রহণযোগ্য, একইভাবে সকলের সমঅধিকার, অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যবিরোধী মূল্যবোধের উপর আঘাতও একই মাত্রায় অগ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। এ ধরনের ধারা যদি সংযুক্ত করতেই হয়, তাহলে ধর্মীয় মূল্যবোধে সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না। সকল মানুষের সমান অধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সার্বিকভাবে বৈষম্যহীন মূল্যবোধের প্রতি আঘাত আনে এমন মন্তব্যও সমানভাবে অগ্রহণযোগ্য হবে, এমন ধারা সন্নিবেশ করতে হবে।

আমরা মনে করি, অধ্যাদেশটি বর্তমান অবস্থায় জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করবে না। আমরা আশা করি, অধ্যাদেশটি প্রণয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে ঢেলে সাজানো হবে, যাতে সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কনভেনশনসমূহ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি সুরক্ষিত হয়।’

টিআইবি সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ পর্যালোচনা করেছে এবং সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে, এই অধ্যাদেশের কাঠামো এবং বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অধ্যাদেশটি সাইবার সুরক্ষা, সাইবার অপরাধ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় একত্রিত করার চেষ্টা করলেও, এর অস্পষ্ট শব্দাবলী ও জটিল ভাষা সাধারণ জনগণ এবং বিশেষজ্ঞদের জন্য বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠেছে।

আবার, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা”, “ব্লকচেইন” এবং “কোয়ান্টাম কম্পিউটিং” এর মতো প্রযুক্তিগত শব্দগুলোর সঠিক সংজ্ঞা না থাকার কারণে আইনের প্রয়োগে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। টিআইবি মনে করে, অধ্যাদেশে সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক ও পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা পূর্বের সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ধারা ২-এ ব্যবহৃত “কম্পিউটার”, “উপাত্ত ভাণ্ডার” এবং “কম্পিউটার সিস্টেম”-এর সংজ্ঞাগুলো অতিরিক্ত বিস্তৃত এবং প্রযুক্তিগত বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা আইনের প্রয়োগে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, অধ্যাদেশের শিরোনাম এবং কাঠামোও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিরোনামে সাইবার সুরক্ষা, সাইবার অপরাধ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা সব কিছু একত্রিত করা হলেও, এতে কিছু অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।

ধারা ৮-এর উপ-ধারা (২)-এ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব, রাজনৈতিক অপব্যবহার বা নাগরিকদের ইন্টারনেট অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে। ধারা ১৬ ও ১৭-এ সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সনদপ্রাপ্ত মনিটরিং প্রক্রিয়া এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাঙার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বিধান থাকা উচিত। ধারা ২৫-এ সাইবার বুলিং, অপমান, হয়রানি বা ব্ল্যাকমেইলের বিষয়টি খুবই বিস্তৃত এবং বিভ্রান্তিকরভাবে আনা হয়েছে, যা যুক্তিসঙ্গত সমালোচনাকেও “অপমান” বা “হয়রানি” হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে, ফলে জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। এ কারণে, এই ধারাটি সংশোধন করে সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার আইন ও উদীয়মান প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম টিআইবির পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন। এ সময় ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন।