জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সবার জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমার সেবা উন্মুক্ত করেছে। সেই সঙ্গে করদাতাদের অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে উৎসাহ কর হচ্ছে। এখন যেকোনো করদাতা চাইলে অনলাইনে নিবন্ধন নিয়ে ঘরে বসেই তাঁর আয়-ব্যয়ের তথ্য জানিয়ে এ বছরের আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।
প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন দাখিলের জন্য এবার অনলাইনব্যবস্থা চালু করেছে এনবিআর। এ বিষয়ে এনবিআরের স্লোগান হচ্ছে, ‘না দাঁড়িয়ে লাইনে, রিটার্ন দিন অনলাইনে’।
রিটার্ন কারা দাখিল করবেন
আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন তাদের দুই ভাগে চিহ্নিত করা যায়। যাদের করযোগ্য আয় রয়েছে ও যাদেরকে আবশ্যিকভাবে রিটার্ন দাখিল করতে হবে তারা আয়কর দাখিল করবেন।
কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার (individual) আয় যদি বছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হয়। মহিলা এবং ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতার আয় যদি বছরে ৪ লাখ টাকার বেশি হয়। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা এবং প্রতিবন্ধী স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার আয় যদি বছরে ৪ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি হয়। গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয় যদি বছরে ৫ লাখ টাকার বেশি হয়।
অনলাইনে রিটার্ন জমার আগে প্রথমে করদাতাকে নিজের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও বায়োমেট্রিক করা মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করে নিতে হবে। নিবন্ধন করার পরই অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে।
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন তথা ই–রিটার্ন দিতে করদাতাকে কোনো কাগজপত্র আপলোড করতে বা জমা দিতে হবে না। শুধু ওই সব দলিলাদির তথ্য দিলেই হবে। যেমন, সনাতনী পদ্ধতিতে চাকরিজীবীদের আয়ের বা বেতন–ভাতার প্রমাণপত্র হিসেবে ব্যাংক হিসাবের এক বছরের লেনদেন বিবরণী (স্টেটমেন্ট) জমা দিলেই চলবে। আগের বছরের ১ জুলাই থেকে পরের বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত (অর্থবছর) সময়ের ব্যাংক হিসাবের স্থিতি, সুদের তথ্য ও ব্যাংক হিসাবের নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য দিতে হবে।
এছাড়া কোনো করদাতা অনলাইনে নিবন্ধন ও রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কোনো সমস্যায় পড়েন, সেক্ষেত্রে এনবিআরের কল সেন্টারে ফোন করলে কর কর্মকর্তারা সমস্যার সমাধান করে দেন। এ-সংক্রান্ত কল সেন্টার প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চালু আছে। কল সেন্টারের নম্বর ০৯৬৪৩৭১৭১৭১।
এদিকে মাঝেমধ্যে অনলাইন সিস্টেমে প্রবেশে সমস্যা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে আয়কর কর্মকর্তারা বলেন, একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক করদাতা অনলাইনে ঢোকার কারণে সমস্যা হচ্ছে, তবে তা সাময়িক।
অনলাইনে রিটার্ন তৈরি ও জমা দেওয়া যাবে; আবার কর পরিশোধও করা যাবে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেকোনো করদাতা রিটার্ন জমার পাশাপাশি কর পরিশোধ করতে পারবেন। এ ছাড়া একই অনলাইন ব্যবস্থা থেকে দাখিল করা রিটার্নের কপি, প্রাপ্তি স্বীকারপত্র, আয়কর সনদ, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ডাউনলোড ও প্রিন্ট করতে পারবেন করদাতা।
গত সপ্তাহে কয়েকটি খাতের পেশাজীবীদের অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। যেমন চার সিটি করপোরেশনে অবস্থিত আয়কর সার্কেলের অধিভুক্ত সরকারি কর্মচারী, সারা দেশের তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা, মোবাইল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি, ম্যারিকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) ও নেস্লে বাংলাদেশের কর্মীরা।
যা লক্ষ রাখবেন
প্রতিবছরই আয়কর রিটার্ন জমা নিয়ে বাজেটে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তবে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। গতবারের মতো এবারও বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। প্রতিবছর জুলাই থেকে পরের বছরে জুন মাস পর্যন্ত আপনি যত করযোগ্য আয় করবেন, এর ওপরই কর দিতে হবে।
করমুক্ত আয়সীমা অতিক্রম করলে ন্যূনতম কর আগের মতোই আছে। এর পরিমাণ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটির করদাতাদের জন্য ৫ হাজার টাকা। অন্যান্য সিটির করদাতাদের ন্যূনতম কর ৪ হাজার টাকা এবং অন্য এলাকার করদাতাদের ৩ হাজার টাকা।
এ ছাড়া কোনো করদাতার বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকার কম হলে এক পাতার রিটার্ন ফরম পূরণ করলেই চলবে। এক পাতার ফরমে সব মিলিয়ে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হবে। এগুলো হলো করদাতার নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর (এনআইডি), কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), সার্কেল, কর অঞ্চল, করবর্ষ, আবাসিক মর্যাদা, মোবাইল নম্বরসহ যোগাযোগের ঠিকানা, আয়ের উৎস, মোট পরিসম্পদ, মোট আয়, আরোপযোগ্য কর, কর রেয়াত, প্রদেয় কর, উৎসে কর কাটার পরিমাণ (যদি থাকে), এই রিটার্নের সঙ্গে প্রদত্ত কর, জীবনযাপনের ব্যয়।
অর্ধশতাধিক সরকারি–বেসরকারি সেবা পেতে এখন আয়কর রিটার্ন জমার রসিদ লাগে। তাই এসব সেবা পাওয়ার চিন্তাভাবনা বা সম্ভাবনা থাকলে আপনাকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগ করে কর রেয়াতের সুযোগও নিতে পারেন করদাতারা।
চেকলিস্টে নজর রাখুন
রিটার্ন জমার সময় প্রমাণপত্র হিসেবে কিছু কাগজপত্র লাগে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস থেকে এসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এখনই জোগাড় করে রাখুন। বেতন খাতের আয়ের দলিল, সিকিউরিটিজের ওপর সুদ আয়ের সনদ, ভাড়ার চুক্তিপত্র, পৌরকরের রসিদ, বন্ধকি ঋণের সুদের সনদ, মূলধনি সম্পদের বিক্রয় কিংবা ক্রয়মূল্যের চুক্তিপত্র ও রসিদ, মূলধনি ব্যয়ের আনুষঙ্গিক প্রমাণপত্র, শেয়ারের লভ্যাংশ পাওয়ার ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্ট, সুদের ওপর উৎসে কর কাটার সার্টিফিকেট, মূলত এসব কাগজপত্র লাগে।
বিনিয়োগ করে কর রেয়াত পেতে চাইলেও কিছু কাগজপত্র লাগবে। যেমন জীবনবিমার কিস্তির প্রিমিয়াম রসিদ, ভবিষ্য তহবিলে দেওয়া চাঁদার সনদ, ঋণ বা ডিবেঞ্চার, সঞ্চয়পত্র, শেয়ারে বিনিয়োগের প্রমাণপত্র, ডিপোজিট পেনশন স্কিমে (ডিপিএস) চাঁদার সনদ, কল্যাণ তহবিলের চাঁদা ও গোষ্ঠী বিমার কিস্তির সনদ, জাকাত তহবিলে দেওয়া চাঁদার সনদ।
নতুন উদ্যোগে সফলতা
এর আগেও এনবিআর অনলাইনে রিটার্ন জমার ব্যবস্থা করলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। এমনকি করদাতাদের মধ্যেও কোন উৎসাহ দেখা যায়নি। ২০১৬ সালে ৫১ কোটি টাকা খরচ করে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হলেও কেউ অনলাইনে রিটার্ন জমা না দেয়ায় ২০১৯ সালে ওই সিস্টেম বন্ধ করে দেয়া হয়।
পরে ২০২০ সালে এনবিআরের আয়কর বিভাগের একটি বিশেষ দল মাত্র দুই কোটি টাকা খরচ করে নতুন অনলাইন ব্যবস্থা চালু করে। গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দুই লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দেন।