চলতি বছরে দেশে সোনার দাম রেকর্ড করেছে। দফায় দফায় দাম বেড়েছে সোনার; সে তুলনায় কমেছে সামান্য। এ বছরই দেশে প্রথমবারের মতো সোনার দাম ভরিপ্রতি লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। দাম বাড়ায় এ বছর নতুন নতুন রেকর্ড হয়েছে, বছর শেষে দেশের ইতিহাসে সোনার এখন সর্বোচ্চ দাম।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চলতি বছর বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির মতো কারণগুলো স্থানীয় বাজারে সোনার মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশের বাজারে ২৯ বার সোনার দাম সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। এর মধ্যে দাম কমানো হয়েছে ১১ বার, বাড়ানো হয়েছে ১৮ বার। বছরের শুরুতে গত জানুয়ারিতে ভালো মানের, অর্থাৎ হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের ১ ভরি সোনার দাম ছিল ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। কয়েক দফা দাম বাড়ার পর গত ২১ জুলাই দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো প্রতি ভরি সোনার দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর সোনার দাম বেড়ে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকায় পৌঁছায়, যা এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
সাধারণ ক্রেতারা দুশ্চিন্তায়
জুয়েলার্স সমিতির সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, দেশের বাজারে এখন হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকা। আর হলমার্ক করা ২১ ক্যারেট সোনা ভরিপ্রতি ১ লাখ ৬ হাজার ২৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট সোনা ৯০ হাজার ৮৬৩ টাকা ও সনাতন পদ্ধতির সোনা ৭৫ হাজার ৬৯৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বছরের শেষ দিনে নতুন করে দাম না বাড়লে এগুলোই এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যারেটে সোনার সর্বোচ্চ দাম।
সোনার দাম হু হু করে বাড়তে থাকায় সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে যাঁরা অলংকার কেনার কথা ভাবছিলেন, তাঁদের দুশ্চিন্তা কেবলই বাড়ছে। সোনার অলংকার দিন দিন তাঁদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। জুয়েলারি ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, সোনার গয়না বিক্রি কমেছে। তবে ব্যাংকসহ যাঁরা সোনাকে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করে, তাদের কাছে সোনার চাহিদা বেড়েছে। এ ছাড়া দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরোনো সোনা কিংবা অলংকারের সম্পদমূল্যও বেড়েছে। এ কারণে অনেকে বেশি মুনাফার আশায় পুরোনো গয়না বিক্রি করছেন।
বেড়েছে রুপার দরও
এদিকে দীর্ঘদিন এক দরে স্থির থাকার পর চলতি মাসে রুপার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় জুয়েলার্স সমিতি। প্রতি ভরিতে রুপার দাম সর্বোচ্চ ৩৮৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তাতে ভালো মানের অর্থাৎ হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি রুপার দাম বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ১০০ টাকা। এ ছাড়া ২১ ক্যারেট রুপা প্রতি ভরি ২ হাজার ৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট রুপা ১ হাজার ৭১৫ টাকা ও সনাতন পদ্ধতির রুপার দাম ১ হাজার ২৮৩ টাকা হয়েছে।
বিশ্ববাজারের দামের প্রভাব দেশে
স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ার মূল কারণ, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে মূল্যবান এই ধাতুর দাম বেড়েছে। ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১ দশমিক ১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম (স্পট প্রাইজ) ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এত দিন ধরে সেটিই ছিল ইতিহাসে সোনার সর্বোচ্চ দাম। কিন্তু ১ ডিসেম্বর সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় ওঠে সোনার দাম, আউন্সপ্রতি সোনা তখন বিক্রি হয় ২ হাজার ৭২ ডলারে।
সর্বশেষ ২৮ ডিসেম্বর সোনার দাম আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৭৫ ডলারের ওপরে উঠে গেছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) হিসাবে, এটিই এখন পর্যন্ত ইতিহাসে সোনার সর্বোচ্চ স্পট প্রাইজ।
সোনার মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা অন্যতম কারণ। গত বছর শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব এ বছরেও কমবেশি ছিল। এর সঙ্গে বছরের শেষ দিক যুক্ত হয়েছে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। ডব্লিউজিসি বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে সোনার চাহিদা বৃদ্ধির পেছনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতন ও হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। ডব্লিউজিসির হিসাবে, ভূরাজনৈতিক ঘটনাগুলোর কারণে এ বছর সোনার দাম ৩ থেকে ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২৪ সালে কী হবে
ডব্লিউজিসির আরেক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বের ২৪ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কিন ডলারের রিজার্ভ নিয়ে হতাশায় রয়েছে। এ কারণে তারা সোনার রিজার্ভ বাড়াতে চায়। ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনার চাহিদা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগামী বছরও অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তাইওয়ান, ভারতসহ বেশ কয়েকটি বড় অর্থনীতির দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এটিও সোনার দামে প্রভাব রাখতে পারে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কার্যনির্বাহী সদস্য দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে চলতি বছর সোনার দামে বড় ধরনের ওঠানামা ছিল। আগামী বছরও সোনার উচ্চ চাহিদা থাকবে। তবে সোনার দাম ধারাবাহিকভাবে না বেড়ে একটি রেঞ্জ-বাউন্ড বা উচ্চ সীমার মধ্যে ওঠানামা করবে।