ঢাকা || ২১ নভেম্বর ২০২৪

নজিরবিহীন অনিয়ম পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্সে

নজিরবিহীন অনিয়ম পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্সে

ব্যাংক ইনফো

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

নজিরবিহীন অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে বেসরকারি খাতের জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। এক সময়ের জনপ্রিয় এবং ব্যবসা সফল এই বিমা কোম্পানিটি এখন ধুঁকছে। পপুলার লাইফের আজকের এ অবস্থার পেছনে রয়েছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বি এম ইউসুফ আলী ও কোম্পানি সচিব মোস্তফা হেলাল কবির। কোম্পানি বাঁচাতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ একচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) অভিযোগ এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা করেছেন পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম হাসান আহমেদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস।  বিএসইসিতে করা অভিযোগ অনুসারে, ২০২১ সালের শুরুর দিকে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তা পরিচালক হাসান আহমেদকে অবৈধভাবে সরিয়ে দেন বি এম ইউসুফ আলী। এক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এমডির অবৈধ কর্মকাণ্ডের প্রতিকার চেয়ে বিএসইসিতে নিজেও অভিযোগ দিয়েছিলেন হাসান আহমেদ। বিএসইসিতে অভিযোগ দেওয়ার পাশাপাশি আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বি এম ইউসুফ আলী ও মোস্তফা হেলাল কবির নানা ধরনের মামলা-হামলা, হুমকি ও ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেন হাসান আহমেদ ও তার পরিবারকে। বিভিন্ন ভাবে ব্ল্যাকমেল করে হাসান আহমেদের অর্থ সম্পদ লুটপাট করে নেন তারা। অসুস্থতা ও কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিশ্বাসঘাতকতার মানসিক নির্যাতনের ধকল সইতে না পেরে হাসান আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিজের, পরিবারের ও কষ্টের প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা চেয়েছিলেন তিনি। হাসান আহমেদের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী-সন্তানকে বঞ্চিত করার নতুন খেলায় মেতে ওঠে বি এম ইউসুফ আলী ও মোস্তফা হেলাল কবির সিন্ডিকেট। হাসান আহমেদের বাকপ্রতিবন্ধী ভাই কবির আহমেদকে ফুঁসলিয়ে বি এম ইউসুফের ভাই বি এম শওকতসহ অন্যরা মিলে হাসান পরিবারের সমস্ত সম্পত্তি আত্মাসাতের চক্রান্ত করছেন বলে হাসানের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসের অভিযোগ। জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, তার এবং পরিবারের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। স্বামী হাসান আহমেদের স্বাক্ষর জাল করে প্রায় ২৬ কোটি টাকা আত্মাসাৎ করেছে বি এম ইউসুফ আলী ও মোস্তফা হেলাল কবির সিন্ডিকেট। এসব ঘটনায় জান্নাতুল ফেরদৌস চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে একটি মামলা করেন। যার নং ৩১৮/২০২১। মামলাটি এখন বিচারাধীন।

জান্নাতুল ফেরদৌস অভিযোগে জানান, হাসান আহমেদের মৃত্যুর পর পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার থেকে তাকে বঞ্চিত করার পাশপাশি নানাভাবে হয়রানি করছেন বি এম ইউসুফ। ফলে স্বামীর মৃত্যুর পর তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। পপুলার লাইফে নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি বি এম ইউসুফ গংদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস। এদিকে বি এম ইউসুফ আলী যোগদান করার পর থেকেই বিতর্ক তালিকায় বারবার নাম উঠে এসেছে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নাম। বিমা খাতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ বিধিমালায় কোনো ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সিইও বা অন্য নির্বাহী কর্মকর্তারা একই সঙ্গে অন্য কোনো কোম্পানির পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনায় থাকতে পারবেন না। এমন বিধান থাকলেও তা মানেনি পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও বি এম ইউসুফ আলী এবং অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা হেলাল কবির। তারা উভয়েই এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পর্ষদে রয়েছেন। বিষয়টি জানার পরও এ নিয়ে কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১৬ সালে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বি এম ইউসুফ আলী ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বি এম শওকত আলীসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যবস্থাপনা খরচ দেখিয়ে পপুলার লাইফের ২৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা নিজেরা ভাগ করে নিয়েছেন। তবে রহস্যজনক কারণে সেই অনুসন্ধান বিষয়ে পরবর্তীতে আর কিছু জানা যায়নি।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে পপুলার লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদ আগলে রাখা বি এম ইউসুফ আলী এক সময় ছিলেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সক্রিয় কর্মী। ২০১৩ সালের ২৩ আগস্ট পরিস্থিতি বুঝে সুযোগসন্ধানী বি এম ইউসুফ ঢাকঢোল পিটিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পত্তিকে বৈধতা প্রদান ও পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি দখলের নীলনকশা বাস্তবায়ন করা। যে হাসান আহমেদ বি এম ইউসুফ আলীকে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরি দিয়েছিলেন, সেই হাসান আহমেদকেই প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেন ইউসুফ আলী। গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। হাসান আহমেদ মৃত্যুর আগে তার ভিডিও বার্তায় অভিযোগ করে যান, ইউসুফ আলী পপুলার লাইফের গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। দেশে-বিদেশে নামে বেনামে গড়ে তুলেছেন অজস্র সম্পদ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পপুলার লাইফের একটি সূত্র জানায়, দরিদ্র পরিবারের সন্তান ইউসুফ আলী গত দুই দশকে অভিজাত বনে গেছেন। চাকরির টাকায় এমন উত্থান একেবারেই অসম্ভব। সবই এসেছে পপুলার লাইফে করা দুর্নীতি থেকে। সূত্র মতে বি এম ইউসুফ আলীর সম্পত্তির তালিকায় রয়েছে বাড়ি নম্বর ৬, রোড নম্বর-৪, সেকশন ১১, মিরপুর, পল্লবী ঢাকার বাড়ি, রোড নম্বর-১০/এ , বাড়ি নম্বর ৫১/এ ধানমন্ডির বাড়ি, নারায়ণগঞ্জ গাউছিয়ায় নূর ম্যানশনে নিজের নামে বাড়ি, আমেরিকার বাফেলোতে দুটি বাড়ি ও দুটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় ৩০টি ফ্ল্যাট।  একইভাবে বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব মোস্তফা হেলাল কবির। তার রয়েছে, পরিজাত ভিলা, কে এম দাস লেন রোড, ১৩/ক/১/৬, টিকাটুলী ওয়ারী ঢাকার ১০ তলা বাড়ি, বেনামে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার, বাফেলোতো বি এম ইউসুফের সঙ্গে অংশীদারিত্বে বাড়ি ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।  জানা গেছে, বি এম ইউসুফ আলী ও মোস্তফা হেলাল কবিরের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটিলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল বি এম ইউসুফ আলী ও মোস্তফা হেলাল কবিরকে বেশ কয়েকবার তাদের মোবাইল ফোনে কল করে কোনো রেসপন্স পাওয়া যায়নি।