ঢাকা || ১০ জানুয়ারি ২০২৫

বাচ্চুর নেতৃত্বে মিলেমিশে বেসিক ব্যাংক লুটপাট

বাচ্চুর নেতৃত্বে মিলেমিশে বেসিক ব্যাংক লুটপাট

বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ৫ জানুয়ারি ২০২৫

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও পরিচালনা পর্ষদ যৌথভাবে লুট করে বেসিক ব্যাংক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী পরিবারের পছন্দের লোক বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু এই লুটের নেতৃত্ব দিয়েছেন। 
তখন ব্যাংকটির পর্ষদে ছিলেন সচিব, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক, সাবেক মহাপরিচালক, সাবেক কাস্টমস কমিশনারসহ আওয়ামী লীগ নেতারা। ঋণ কেলেঙ্কারির মামলায় বেসিক ব্যাংকের বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদকে বাদ দেওয়ায় তিন তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেছেন আদালত। 
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেসিক ব্যাংক লুটপাটে আবদুল হাই বাচ্চু একা নয়, পুরো পর্ষদই জড়িত ছিল। ব্যাংকের তৎকালীন এমডিসহ পর্ষদের সকল সদস্যকে বিচারের আওতায় আনার জন্য তাদের সম্পদের হিসাব নেওয়া উচিত সরকারের।

শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর যোগদানের মাধ্যমে বেসিক ব্যাংককে লুটপাটের কাজ শুরু হয়। ব্যাংকটি লুটপাট করা হচ্ছে জেনেও তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০০৯-১৪ সালে বাচ্চুর মেয়াদে নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকটির সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়। 
লুটপাটের ফলে বেসিক ব্যাংকের দেওয়া ঋণের ৬৪ শতাংশই এখন খেলাপি। গত ১০ বছরে ব্যাংকটির লোকসান হয়েছে ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকায়। 

বেসিক ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। যোগদান দেন ৫ অক্টোবর। তখন সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাংকটির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান, ফখরুল ইসলাম, শ্যাম সুন্দর শিকদার। সিদ্দিকুর রহমান মারা যাওয়ায় বিসিকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যাংকের একটি (২৭৬তম) পর্ষদ সভায় যোগ দিয়েছেলেন খায়রুল আনাম। 

এছাড়াও অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুন নাহার আহমেদ, সাবেক অতিরিক্ত সচিব একেএম রেজাউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক নিলুফার আহমেদ, শুভাশিষ বসু, সাবেক কাস্টমস কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন।

বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান চাদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও হিসাব বিজ্ঞান ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী আখতার হোসেন, এআরএস লুব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম, চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্টস প্রতিষ্ঠান ইসলাম আফতার কামরুল অ্যান্ড কোম্পানির পার্টনার একেএম কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের মুখপত্র উত্তরনের সহকারী সম্পাদক আনিস আহমেদ। 
রাজিয়া বেগম ও সিদ্দিকুর রহমান ২০১০ সালের ৩১ জুলাই মানিকগঞ্জে সড়ক দূূর্ঘটনায় মারা যান। তারা দুজন ওইদিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বেসিক ব্যাংকের শাখা উদ্ধোধন করতে যাচ্ছিলেন।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেন ২০১৪ সালের ৫ জুলাই পদত্যাগ করেন আবদুল হাই বাচ্চু। এই সময়ে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে ছিলেন, একেএম সাজেদুর রহমান, শেখ মনজুর মোর্শেদ ও কাজী ফকরুল ইসলাম। 
২০০৮ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমডি ছিলেন একেএম সাজেদুর রহমান। ২০১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের ৮ জুন পর্যন্ত ছিলেন শেখ মনজুর মোর্শেদ। মনজুর মোর্শেদের পর এমডি হিসেবে নিয়োগ পান কাজী ফকরুল ইসলাম। ২০১৪ সালের ২৫ মে তাকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর আমলে বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এসব সরকারি কর্মকর্তারে বেশির ভাগই পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র সচিব, সচিব হন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়। ওই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন সাবেক সচিব শ্যামসন্দর সিকদার, যিনি পরে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান হন। 
শুভাশিষ বসু হয়েছিলেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) চেয়ারম্যান এবং পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। পরিচালনা পর্ষদের যারা সদস্য ছিলেন তারা প্রায় সবাই এখন বিদেশে আরাম আয়েশে জীবন কাটাচ্ছেন।

বেসিক ব্যাংকের পরিচালক সরকারি কর্মকর্তারা পরবর্তীতে পদোন্নতিসহ নানা রকম সুবিধা পাওয়ায় বিশ্লেষকরা মনে করেন আবদুল হাই বাচ্চু একা নন, তার নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ ও এমডিও বেসিক ব্যাংক লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাই তারেও বিচারের মুখোমুখি করা হোক। লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের হিসাব নেওয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে মাত্র দুইজন পরিচালক লুটপাটের প্রতিবাদ করেছিলেন। তারা হলেন,  সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ কামরুল ইসলাম এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ কে এম রেজাউর রহমান। আবদুল হাই বাচ্চুর অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে রেজাউর রহমান অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পরে রেজাউর রহমান এবং কামরুল ইসলামকে বেসিক ব্যাংকে আর ঢুকতে দেয়নি বাচ্চু সিন্ডিকেট। 
এবিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি একচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, রাজনীতিবিদ, অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যবসায়ী, বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের একটি চক্র মিলে ব্যাংকটি লুটপাট করেছে। পুরো ব্যাংকখাতে যে লুটপাটের চক্র গড়ে উঠেছিল বাচ্চু ছিল তারই অংশ। এদের সবাইকে একযোগে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।

এবিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চেয়ারম্যান হিসেবে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বড় অপরাধী তাতে কোনো সন্দেহ নাই। একই সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদে যারা ছিলেন, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় যারা ছিলেন, বিশেষ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ উর্ধ¦তন কর্মকর্তারা লুটপাটের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। 
তিনি আরো বলেন, তদারকি সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায় আছে। কারণ তারা লুটপাট করতে দিয়েছে, কোনো ব্যবস্থা নেয় নাই। বেআইনি ভাবে ব্যাংকটি লুটপাট করা হয়েছে। যারা বাচ্চুকে চুরি করার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে, সহায়তা করেছে তারাও অপরাধী। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রণালয় এবং সরকারও এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এই নজরদারির মধ্যে থাকার কথা ছিল। কাজেই এই অপরাধের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়, সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কেউ দায়ভার এড়াতে পারে না। নিজ নিজ দায়িত্ব পালন না করার কারণে সকলেই অপরাধী। বেসিক ব্যাংক লুটপাটের সঙ্গে যারা জড়িত সবাই বেআইনি সুযোগ সুবিধা গ্রহন করেছে। কাজেই তাদের সবারই বিচার হওয়া উচিত।

এদিকে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের করা ১৬ দুর্নীতির মামলার তিন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিন কর্মকর্তাকে তলব করেছেন আদালত। এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তারা ত্রæটিপূর্ণ প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেছে। এসব প্রতিবেদনে ব্যাংক পর্ষদে যারা ছিলেন বিশেষ করে যারা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পর্ষদ সদস্য ছিলেন তাদেরকে বাদ দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

ঢাকার এক নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবুল কাশেম গত বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন। আদেশে ব্যাংকের দুর্নীতির সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদ জড়িত কিনা সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছেন আদালত। তলব করা কর্মকর্তারা হলেন- দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও সিরাজুল হক। এই তিন কর্মকর্তা মামলাগুলো তদন্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছেন।