আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাপক অনিয়মের কারণে, তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা বেসরকারিখাতের চার ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে টাকা না ছাপিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এই অর্থ সহায়তা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এই চারটি ব্যাংক অর্থ সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল সহায়তা চেয়েছে। এরমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১৫ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
গত মঙ্গলবার সকালে এই চার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সঙ্গে মিটিং করে— ব্যাংকগুলো কতো টাকা যোগান পেলে সংকট থেকে বের হতে পারবে, সেই তথ্য নিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। পরে প্রতিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিদের সঙ্গে পৃথকভাবে সভা করেছেন গভর্নর। তখন কোন ব্যাংককে কি পরিমাণ অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন গভর্নর।
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ব্যাংকগুলোর তারল্য সহায়তা নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, সভায় গভর্নর ব্যাংকগুলোকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে টাকা ছাপিয়ে তাদের সহায়তা করা হবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম এবং বিল ও বন্ড বাজারে বিক্রির নিজস্ব আয় থেকে ব্যাংকগুলোকে এই সহায়তা দেবে।
এস আলমের সাথে কাজ করার নির্দেশ
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে ব্যাংকগুলো এস আলম গ্রুপের এলসি খুলতে রাজি হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে রমজানের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিশ্চিত করতে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ভোজ্যতেল, চিনি ও আটা-ময়দার কোম্পানিগুলোর এলসি খুলতেও ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন গভর্নর।
কোন ব্যাংক কত টাকা চেয়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবিএল)।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, "বর্তমানে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করার প্রক্রিয়াটি বেশ শ্লথগতির। আমরা পাঁচ থেকে সাতটি ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করেছি, আমাদের প্রস্তাবগুলো তারা তাদের বোর্ডের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। অনুমোদন হলে একেকবারে মাত্র ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকা পাওয়া যায়।"
এভাবে গত আড়াই মাসে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকার মতো পেয়েছে এফএসআইবিএল, যা ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানত তুলে নেওয়ার চাপ মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বেসরকারিখাতের পুরনো এই ব্যাংকটিকে ৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিতে পারে বলে জানা গেছে।
অন্য ব্যাংক থেকে ন্যাশনাল ব্যাংক এখন পর্যন্ত ৮০০ কোটি টাকা ধার পেয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কিন্তু, আমানতকারীদের টাকা তোলার চাপের কাছে এই তহবিল তেমন স্বস্তি দিতে পারেনি ব্যাংকটিকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা পেলে ন্যাশনাল ব্যাংক তিন মাসের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে উল্লেখ করে— ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু টিবিএসকে বলেন, "দীর্ঘদিন একটা পরিবারের করায়ত্ত থাকায় ব্যাংকটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহুবিধভাবে অন্যায়-দুর্নীতি হয়েছে। গত ১৫ বছরে ব্যাংকের আসল মালিক-গ্রাহকদের স্বার্থ বাদ দিয়ে মুষ্টিমেয় শেয়ারহোল্ডাররা মালিক দাবি করে এসব করেছে। গ্রাহকদের আস্থা বাড়ানোই আমার প্রথম কাজ।"
বেক্সিমকোসহ বড় বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে আছে ন্যাশনাল ব্যাংকের। এসব গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারের কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এখন কোন কোন ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে সেটেল করছি, যারা ১ থেকে ২ কোটি টাকার মতো ছোট অংকের ঋণ নিয়েছে। এরপর বড় বড় গ্রাহকদের সঙ্গে আমরা নেগোসিয়েশন (আলোচনা) শুরু করব। তাদের ব্যবসা বন্ধ করে— আমরা টাকা আদায়ের পথে যাব না। বরং ব্যবসা সচল রেখে কীভাবে তারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে পারে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেব।"
যেসব ব্যাংক চরম তারল্য সংকটে
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে আমানতকারীদের টাকা দিতে পারছে না। অনেক গ্রাহক দিনের পর দিন ঘুরেও ব্যাংকগুলো থেকে সামান্য পরিমাণ টাকাও পাচ্ছেন না।
তাদের মতে, আরও দুটি সংকটে থাকা ব্যাংক হচ্ছে – এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংক ও নাফিজ শারাফাতের মালিকানাধীন পদ্মা ব্যাংক, তবে এই দুই ব্যাংককে সহায়তা দেওয়ার জন্য ডাকেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের বেসরকারিখাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক-ও মারাত্মক তারল্য সংকটে পড়েছিল। তবে ব্যাংকটি এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে — অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করে চলার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণের গ্যারান্টার হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ তারল্য প্রয়োজন, এই পদ্ধতিতে সে পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে না তারা।
আমানতকারীদের পাওনা অর্থ ফেরত সরকারের উদ্যোগ
এমন পরিস্থিতিতে অর্থ সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো যাতে আমানতকারীদের পাওনা অর্থ ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি – নতুন ঋণ বিতরণ করে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে পারে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রত্যক্ষ সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক গত মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "যেসব ব্যাংক অর্থ সংকটের কারণে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, তাদের সহায়তার জন্য খুব শিগগিরই আপনারা নতুন উদ্যোগ দেখতে পাবেন।"
আলোচিত চারটি ব্যাংকসহ অন্তত ১২টি ব্যাংক আওয়ামী আমলের বিভিন্ন ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে চরম তারল্য সংকটে রয়েছে। এরমধ্যে আটটি ব্যাংকের মালিকানায় এর আগে ছিল বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ।
এত অনিয়ম সত্ত্বেও শেখ হাসিনার আমলের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি। এমতাবস্থায়, তারল্য সংকট আরও গভীর রূপ নেয়, কিন্তু এসব ব্যাংকের চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকার পরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক বিধিমালা ভঙ্গ করে সহায়তার অনুমোদন দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর নিযুক্ত হন আহসান এইচ মনসুর, তিনি দায়িত্ব নিয়েই আগের এসব অন্যায্য সুবিধা বন্ধ করেন, যাতে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থা উঠে আসে।
২০২৪ সালের আগস্ট শেষে, বেসরকারি খাতের ৯ ব্যাংকের চলতি হিসাবের ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা জানানো হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, এস আলম গ্রুপের দখলমুক্ত করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে, সবচেয়ে বড় ঘাটতি হচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের, যার পরিমাণ ৭ হাজার ২৬৯ কোটি টাকারও বেশি। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা, অন্যদিকে ঘাটতিতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ২ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা।