ঢাকা || ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পিতৃপুরুষের বাড়াবড়িতেই ব্যাংকখাতের সর্বনাশ: সুদ মওকুফ ও ৯-৬ সীমা নির্ধারনের জনক নজরুল ইসলাম মজুমদার

পিতৃপুরুষের বাড়াবড়িতেই ব্যাংকখাতের সর্বনাশ: সুদ মওকুফ ও ৯-৬ সীমা নির্ধারনের জনক নজরুল ইসলাম মজুমদার

ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস

প্রকাশিত: ১০:২৭, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক কার‌্যক্রমকে কঠিন করে তুলেছিল ব্যাংকখাতের স্বঘোষিত পিতৃপুরুষ নজরুল ইসলাম মজুমদার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয় নজরুল ইসলাম মজুমদারের ক্ষমতার অপব্যবহার।


অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকস (বিএবি) এর চেয়ারম্যান হিসাবে তার মেয়াদকালে বহুবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুদান দিতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করেছিলেন।

সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) অধীনে নগদ অর্থ  বা কম্বলেল মতো অনুদান সংগ্রহ করতেও মজুমদার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

সাধারণ ভাবে সিএসআর তহবিলের অর্থ  ব্যাংকগুলো শিক্ষা, চিকিৎসা এবং সামাজিক-কল্যানে বাস্তবায়িত প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বরাদ্দ রাখে।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের সদস্যদের নামে পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির জন্যও ব্যাংকগুলোকে অনুদান দিতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

আরও জানা গেছে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকাণ্ডও সিএসআর তহবিলেল দিয়েছে মজুমদার, ফলে খাত সংশ্লিষ্টরা তাকে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী বলে অভিহিত করেছেন।

তথ্য মতে, বিএবি দ্বিতীয়বারের মতো 'বিতর্কিত' শেখ হাসিনা আন্তঃব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০২৪ আয়োজন করতে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক (পিসিবি) থেকে প্রায় সাড়ে কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।

বহুল আলোচিত টুর্নামেন্টটি ২০২৩ সালেও সিএসআর তহবিলের বিপুল পরিমান অর্থ ব্যবহার করেও আয়োজন করা হয়েছিল।


এছাড়াও, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ এবং শেখ কামাল যুব গেমসসহ বিভিন্ন ধরণের টুর্নামেন্টের মতো বিভিন্ন কর্মসূচির নামে ব্যাংকগুলোকে ঘন ঘন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান দেওয়ার দিতে বাধ্য করতেন মজুমদার।

দুটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের দুইজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী বলেছেন ক্ষমতার অপব্যবহারকারী মজুমদার শুধুমাত্র ব্যাংকগুলোকে ফুটবল টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা করতে অনুদানের জন্য চাপ দেয়নি বরং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সকল কর্মীদের এক মাসের বেতন প্রদান করতে বলেছিল। তারা একসাথে টুর্নামেন্টগুলি সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য উৎসবে মিলিত হতে (ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে পিয়ন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বেতনও দিতে হয়েছে।

আরও জানা গেছে, বিএবি প্রধান হিসেবে তিনি পরবর্তীতে বিষয়ে চিঠি দিতেন।

সিনিয়র ব্যাংকাররা আরও দাবি করেন যে বেশিরভাগ ব্যাংক শিক্ষা স্বাস্থ্যে সিএসআর-ব্যয়ের প্রয়োজনগুলো মেনে চলতে পারেনি কারণ তহবিলের সিংহভাগ অর্থ টুর্নামেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল এবং আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য কর্মকাণ্ডে দিতে হয়েছে।


এবিষয়ে বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের একটি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস খান বলেছেন, অনুদানকে শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয় যা 'ঘন ঘন এবং জোর করে' ব্যয় করা হবে না। "অনুদান সীমিত হওয়া উচিত। এটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক খাতের উন্নয়নের জন্য প্রদান করা হবে,"

আরেক জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার মেহমুদ হোসেন এটাকে 'অগণতান্ত্রিক' আখ্যা দিয়ে সিএসআর তহবিল থেকে অর্থ ব্যবহার করার প্রক্রিয়া আরোপ করার এই ধরনের অনুশীলনকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

তিনি মনে করেন, ধরনের কর্মকাণ্ড দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করতে বাধা সৃষ্টি করেছে।

ব্যাংক এশিয়া, এনআরবি ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)  আরও বলেছেন, "অনুদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রেখে নেওয়া উচিত।"

তিনি বলেন, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নির্বাহীদেরকেও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল, বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আবাসন প্রকল্পগুলিতে অনুদান দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।

"দান হল এক ধরনের দাতব্য, কিন্তু জোর করে বা চাপিয়ে দিলে এর প্রকৃত মূল্য হারিয়ে যায়," এই ব্যাংকার ব্যাখ্যা করেন।

"এই ধরনের বাধ্যতামূলক সিএসআর ব্যয় ব্যাঙ্কের মুনাফা হ্রাস করে যা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ আয়কে প্রভাবিত করে।"

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার টেকসই অর্থ বিভাগের সাথে সমস্ত তফসিলি ব্যাংক দ্বারা বাস্তবায়িত সামগ্রিক সিএসআর কর্মসূচির তত্ত্বাবধান করছে।

"আমরা সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টের সাথে সঙ্গতি রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব,"

নজরুল ইসলাম মজুমদার২০০৮ সাল থেকে বিএবি- নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সুবিধা প্রদানের জন্য ঋণ এবং আমানত উভয়ের উপর সুদের হারের উপর একটি ক্যাপ আরোপের একজন স্থপতিও ছিলেন তিনি।

অর্থনীতিবিদদের মতে, গত কয়েক বছরে বাজার-ভিত্তিক সুদ ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সুদের হার নির্ধারণ করে দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।
এর আগে ২০১৮ সালের ২০ জুন  মজুমদারের নেতৃত্বে, বিএবি প্রথমে ওই অর্থ বছরের জুলাই থেকে ঋণ এবং আমানত উভয়ের সুদের হার যথাক্রমে  শতাংশ এবং শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়

তার আগে এপ্রিলে সোনারগাঁও হোটেলে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) এবং বিএবির ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজনের মাধ্যমে তিনি ব্যাংকগুলির নগদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা (সিআরআর) শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে নজরুল ইসলাম মজুমদার ২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ২৬১ কোটি টাকার ঋণের সুদ মওকুফ করিয়েছেন বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।

সরকারি ব্যাংকটিরন পরিচালনা পর্ষদের ৬৫৪তম সভায় নাসা গ্রুপের দুটি কোম্পানি নাসা তাইপেই স্পিনারস এবং নাসা স্পিনার্সর সুদ মওকুফ অনুমোদন করেছে। ।

এর আগে ২০০৮ সালে, জনতা ব্যাংক নাসা গ্রুপের ওই দুই কোম্পানির ১২০ কোটি টাকার ঋণ অধিগ্রহণ করেছিল সাউথইস্ট ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে।

বোর্ড সভার কার্যবিবরণী অনুসারে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটি নাসা তাইপেইকে ২০২১ সালেল ৩১ আগস্ট ১৫৬ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করার শর্তে এই সুবিধা প্রদান করেছে।

নিয়মবহিভূত সুবিধা দেওয়ায় ২০২১ সালের জুনে, 'ব্যাংকিং নিয়মের লঙ্ঘন' বলে অভিহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক সুবিধাটি বাতিল করেছিল।

জানা গেছে, রাজনৈতিক চাপে পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সুদ মওকুফ সুবিধা অনুমোদন করে।

সার্বিক বিষয়ে নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি